সিএ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য- ২০২৩: সিএ কি, কিভাবে পড়তে হয়, কত খরচ হয়, কেমন জব পাওয়া যায়?
সিএ বা চার্টার্ড একাউন্টেন্সি একটা বিশ্বমানের পেশাগত ডিগ্রি। দেশে এবং দেশের বাইরে এই ডিগ্রি অর্জনকারীরা খুব ভালো বেতনে চাকুরী পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে বর্তমানে ২,০০০ এর কম এই সনদধারী রয়েছে, যা দেশের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। অনেক কোম্পানি ভারত, শ্রীলংকা থেকে সিএ নিয়োগ করে থাকে।
অনেকে এই ডিগ্রি সম্পর্কে জানেন না। আজকের এই আর্টিকেলে থাকছে সিএ সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য- সিএ মানে কি, কি কি যোগ্যতা দরকার, কত খরচ হয়, কোথায় পড়বেন, কিভাবে পড়বেন ইত্যাদি বিস্তারিত তথ্য।
Table of Contents
সিএ (CA) মানে কি?
সিএ বা চার্টার্ড একাউন্টিং এর বাংলা হলো সনদ প্রাপ্ত হিসাব বিদ্যা। হিসাববিদ্যা বা একাউন্টিং হলো কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক হিসাব সংরক্ষণ ও আর্থিক প্রতিবেদন বা রিপোর্ট তৈরী করা।
সিএ একই সাথে একটি ডিগ্রি এবং একটি পেশার নাম। যে কারণে এটাকে পেশাগত ডিগ্রি বলা হয়। যেমন একজন ছাত্র ওকালতি পড়ে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত হন। যে কারনে ওকালতি ও একটি পেশাগত ডিগ্রি।
অন্যদিকে বিএ/বিবিএ ডিগ্রি অর্জন করে বিএ/বিবিএ পেশায় যুক্ত হতে পারেন না। কারন বিবিএ/বিএ ইত্যাদি নামে আদৌ কোনো পেশা নেই। তাই বিবিএ/ এমবিএ কোনো পেশাগত ডিগ্রি না।
আশা করি সিএ ডিগ্রি কি এর উত্তর পেয়েছেন।
যাইহোক, ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড একাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (ICAB) এই সিএ (CA) ডিগ্রি বা সনদ প্রদান করে। ICAB ১৯৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট অর্ডারের মাধ্যমে গঠিত একটি সায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও পাকিস্তান সরকারের অধীনে ICAP থেকে এই ডিগ্রী প্রদান করা হতো।
যারা সিএ ডিগ্রি অর্জন করতে পারেন তাদেরকে বলা হয় চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট (Chartered Accountant)।
সিএ পড়ার সুবিধা কি?
দেশী-বিদেশী কোম্পানি গুলোর ফাইন্যান্স ও একাউন্টিং সেক্টরে সিএ এর স্টুডেন্টদের ব্যপক চাহিদা রয়েছে। সিএ করে কখনো বেকার থাকতে হয়না। কারন সকল প্রতিষ্ঠানেই হিসাববিদ দরকার হয়।
এমনকি সম্পূর্ণ কোর্স পাশ না করলেও চাকুরি পাওয়া যায়। যারা সিএ পাশ করে ফেলেন তারা সরাসরি কোনো প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজারিয়াল পজিশনে জব পেয়ে থাকেন। আর যারা সম্পূর্ণ সিএ কোর্স পাশ করতে পারেন না তারাও প্রতিষ্ঠান গুলোর বিভিন্ন পজিশনে সাধারন বিবিএ এমবিএ ডিগ্রী অর্জনকারীদের তুলনায় খুব সহজে ও বেশি বেতনে জব পেয়ে থাকেন।
সিএ এর বিশেষত্ব কি?
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কোম্পানি গুলো পরিচালনা হয় সেগুলোর বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা বা অডিট করা বাধ্যতামূলক। কোম্পানি আইনে বলা আছে কেবল মাত্র সনদধারী হিসাববিদরা এই নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।
ডেইলি স্টার পত্রিকার ২০২২ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে- বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৬৩১ টি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি; ১,৯৭,৫৬৪ টি নিবন্ধিত প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি ছিলো। এতগুলো কোম্পানি নিরীক্ষার বিপরীতে বাংলাদেশে সনদ ধারী হিসাববিদের সংখ্যা ২ হাজারের কম।
শুধু মাত্র নিরীক্ষা কার্যক্রম না, একজন সিএ কোর্স সম্পন্ন কারী নিন্মের বিষয়েও প্রাকটিকালি পারদর্শী হয়ে থাকেন-
- ফাইনান্সিয়াল একাউন্টিং
- ম্যানেজমেন্ট একাউন্টিং
- ফাইননান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট
- বিজনেস ল’
- ট্যাক্স ও ভ্যাট
- বিজনেস ম্যানেজমেন্ট
এসব কারনে সিএ স্টুডেন্টদের জব মার্কেটে এত চাহিদা।
সিএ পড়ার নিয়ম
সিএতে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার পাশাপাশি হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেয়া বাধ্যতামূলক। ৩ থেকে ৪ বছর এই হাতে-কলমে বা প্রাকটিক্যাল শিক্ষা গ্রহন করা বাধ্যতামূলক। এই হাতে-কলমে বা প্রাকটিক্যাল শিক্ষা গ্রহন করাকালীণ সময়টাকে সিসি পিরিয়ড বা আর্টিকেলশীপ পিরিয়ড বলা হয়।
অপরদিকে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের কোনো নির্দিষ্ট সময় সীমা নেই। আপনি যত দ্রুত পাশ করে ফেলবেন তত তাড়াতাড়ি আপনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন হয়ে যাবে। সারাজীবনে যতদিনে পাশ না করতে পারবেন ততদিনে এক্সাম দিতে পারবেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সিএ ডিগ্রি নিতে হলে একই সাথে দুই ভাবে শিখতে হয়-
১। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
২। হাতে কলমে শিক্ষা
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা মানে আমরা যে সিস্টেমের পরাশুনার সাথে পরিচিত। ক্লাশে পাঠদান, এক্সাম নেয়া, খাতা নিরীক্ষা, সার্টিফিকেট প্রদান ইত্যাদি। তো এই সকল কাজ করে থাকে ICAB
সিএতে মোট তিনটি লেভেল রয়েছে।
সার্টিফিকেট লেভেলঃ
এই লেভেলে মোট ৭টি বিষয় পড়তে হয়। যথা-
- Assurance
- Accounting
- Business & Finance
- Business Law
- Management Information
- Taxation 1
- Information Technology
প্রফেশনাল লেভেলঃ
এই লেভেলেও ৭ টি বিষয় রয়েছে
- Audit & Assurance
- Financial Accounting & Reporting
- Business Strategy
- Corporate Laws and Practices
- Financial Management
- Taxation 2
- IT Governance
এডভান্স লেভেলঃ
এই লেভেলে মোট ৩ টি বিষয় রয়েছে। যথা-
- Corporate Reporting
- Strategic Business Management
- Case Study
হাতে কলমে শিক্ষা
হাতে কলমে শিখার জন্য একজন সিএ স্টুডেন্টকে ICAB তে নিবন্ধিত কোনো সিএ ফার্মে জয়েন করতে হবে।
উক্ত ফার্মের একজন রেগুলার কর্মচারী বা এমপ্লোই এর মতো ডিউটি করে সিএ সম্পর্কিত বিভিন্ন কাজ হাতে কলমে শিখতে হবে। এই কাজ করার বিনিময়ে একজন স্টুডেন্ট কিছু এলাউন্স বা ভাতাও পেয়ে থাকে।
- প্রথম বর্ষে প্রতি মাসে এলাউন্স ৭০০০ টাকা
- ২য় বর্ষে প্রতি মাসে এলাউন্স ৮০০০ টাকা
- ৩য় বর্ষে প্রতি মাসে এলাউন্স ৯০০০ টাকা
- ৪র্থ বর্ষে প্রতি মাসে এলাউন্স ১০০০০ টাকা
একজন চার্ডার্ড একাউন্ট্যান্ট তার পড়াশুনা ও প্রাকটিকাল কাজের মাধ্যমে নিন্মের বিষয় গুলোর ওপর দক্ষ হয়ে থাকে-
- ফাইনান্সিয়াল একাউন্টিং
- ম্যানেজমেন্ট একাউন্টিং
- ফাইননান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট
- বিজনেস ল’
- ট্যাক্স ও ভ্যাট
- বিজনেস ম্যানেজমেন্ট স্ট্রাটেজি ডেভেলপমেন্ট
- আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা
সিএ ভর্তির যোগ্যতা
এইচএসসি পাশ করেই সিএ তে জয়েন করা যায়। আবার অনার্স/মাস্টার্স শেষ করেও সিএতে আসা যায়। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন শিক্ষা বিরতি বা স্ট্যাডি গ্যাপ থাকলেও সিএতে ভর্তি হওয়া যায়।
তবে সিএ তে ভর্তি হলে অন্য কোথাও জব বা পড়াশুনা করার সুযোগ নেই (প্রি-আর্টিকেলশীপ ব্যতিক্রম)।
HSC এর পরে সিএঃ
SSC এবং HSC তে মোট জিপিএ ৮ থাকলে একজন স্টুডেন্ট সরাসরি সিএ তে জয়েন করতে পারবে। সেক্ষেত্রে উক্ত স্টুডেন্ট কে ৪ বছর একটা ফার্মের অধীনে প্রাকটিকাল কাজ শিখতে হবে এবং সিএ এর একাডেমিক পড়াশুনা করতে হবে।
Honours/Masters এ পড়া অবস্থায় সিএ প্রি-আর্টিকেলশীপঃ
যারা অনার্স বা মাস্টার্সে অধ্যয়নরত রয়েছে তারা সিএ এর সার্টিফিকেট লেভেলের ক্লাশ ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।
এই অনার্স বা মাস্টার্সে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রাকটিকাল কাজ শিখতে হবে না। কিন্তু অনার্স বা মাস্টার্স শেষ করে কোনো সিএ ফার্মে জয়েন করে বাধ্যতামূলক ভাবে ৩ বছর প্রাকটিকাল কাজ শিখতে হবে সিএ এর একাডেমিক পড়াশুনা করতে হবে।
Honors/Masters এর পরে সিএঃ
এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স ও মাস্টার্স সব এক্সাম মিলিয়ে মোট ৭ পয়েন্ট থাকলেই সিএ তে জয়েন করা যাবে। কিন্তু কোনো এক্সামে জিপিএ ২.৫ পয়েন্টের নিচে পেলে ভর্তি হতে পারবে না।
অনার্স বা মাস্টার্সের পরে ভর্তি হলে উক্ত স্টুডেন্ট কে ৩ বছর একটা ফার্মের অধীনে প্রাকটিকাল কাজ শিখতে হবে সিএ এর একাডেমিক পড়াশুনা করতে হবে।
ACMA/FCMA and ACCA/FCCA ডিগ্রি নেয়ার পরে সিএঃ এই ডিগ্রি গুলো নেয়ার পরে সিএতে জয়েন করলে উক্ত স্টুডেন্ট কে ২ বছর একটা ফার্মের অধীনে প্রাকটিকাল কাজ শিখতে হবে এবং সিএ এর একাডেমিক পড়াশুনা করতে হবে।
কিভাবে শুরু করতে হবে?
সিএ শুরু করার জন্য প্রথমেই আপনাকে একটি সিএ ফার্মে কজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এর অধীনে জয়েন করতে হবে। বাংলাদেশে মোট ২০০ এর বেশি সিএ ফার্ম আছে।
ফার্মগুলোর পারফরমেন্সের উপর ভিত্তি করে A ক্যাটাগরি, B ক্যাটাগরি, C ক্যাটাগরি ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত বিভক্ত। A ক্যাটাগরি থেকে প্রথম সারির কোনো ফার্মে জয়েন করা উত্তম।
ফার্মে জয়েন করার পর কিছুদিন ( ১ থেকে ৮ মাস বা আরো বেশি ) উক্ত ফার্ম স্টুডেন্টএর কাজ পর্যবেক্ষণ করে।
সবকিছু ঠিক থাকলে উক্ত ফার্মের মাধ্যমে ICAB তে স্টুডেন্ট হিসেবে নিবন্ধন পাওয়া যাবে। এই নিবন্ধন পাবার দিন থেকে সিএ আর্টিকেলশিপ পিরিয়ড বা সিসি পিরিয়ড কাউন্ট শুরু হবে। মানে এই দিন থেকেই হিসেব করে একজন স্টুডেন্টকে আরো ২ বছর /৩ বছর /৪ বছর আর্টিকেলশীপ পিরিয়ড কাটাতে হবে।
সিএ পড়ার খরচ
সিএ পড়তে একজন স্টুডেন্ট এর সর্বনিন্ম ১,২৪,৫০০ টাকা খরচ হবে। সিএ তে এসে রেজিস্ট্রেশনের সময় প্রথম খরচ হয়। এখানে রেজিস্ট্রেশনের জন্য ৮,৯০০ টাকা, সার্টিফিকেট লেভেলের কোচিং ক্লাশের জন্য ১৩,৫০০ টাকা; বইয়ের জন্য ৩,০০০ টাকা; লাইব্রেরী কার্ডের জন্য ২,৫০০ টাকা, ছাত্র পরিষদের ফি ৫০০ টাকা দিতে হয়। মানে মোট ২৮,৫০০ টাকা দিতে হয়। এটাই এককালীন বড় খরচ।
সার্টিফিকেট লেভেলের প্রতি পরীক্ষার ফি ১৫০০ টাকা করে। তবে বিজনেস ল এবং আইটি পরীক্ষার ফি ১২০০ টাকা করে।
এরপর প্রফেশনাল লেভেল এর কোচিং এর জন্য ১৫,০০০ টাকা খরচ হয়। এক্সাম ফি প্রতি সাবজেক্টের জন্য ৩,৩০০ টাকা।
এডভান্স লেভেলে কোচিং ফি মোট ১৮,০০০ এবং কেস স্টাডি এর জন্য ২৫০০০ টাকা। এই লেভেলে এক্সাম ফি প্রতি সাবজেক্টের জন্য ৫,৫০০ টাকা এবং কেস স্ট্যাডি এর এক্সাম ফি ১২,০০০ টাকা।
এভাবে সিএ পড়তে একজন স্টুডেন্ট এর সর্বনিন্ম ১,২৪,৫০০ টাকা খরচ হবে।
অন্যদিকে এলাউন্স বাবদ ফার্ম থেকে সর্বনিন্ম ২,৮৮,০০০ টাকা পাওয়া যাবে নিন্মের হিসেবে-
প্রথম বর্ষে প্রতি মাসে এলাউন্স ৭০০০ টাকা
২য় বর্ষে প্রতি মাসে এলাউন্স ৮০০০ টাকা
৩য় বর্ষে প্রতি মাসে এলাউন্স ৯০০০ টাকা
দেখা গেলো অন্যান্য পড়াশুনার খরচের থেকে সিএ ডিগ্রির পড়াশুনার খরচ তুলনামূলক কম। উপরন্ত এখানে প্রতিমাসে এলাউন্স পাওয়া যায়। ঝামেলা হলো এক্সাম গুলোয় পাশ করা কষ্টকর। বেশিরভাগ সময় সাধারন ছাত্রদের এক এক্সাম অনেক বার দিয়ে পাশ করতে হয়। সেক্ষেত্রে বার বার এক্সাম ফি দিতে হয় যা অনেক ব্যয়বহুল।
তবে এখানে সাময়িক সময়ের জন্য অপরচুইনিটি কস্ট অনেক বেশি। অনার্স লেভেলের পরে এর কম বেতনে এত সময় দেয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কারন যাদের আর্থিক অবস্থা একটু দুর্বল তাদের ফ্যামিলি প্রেসার থাকে। তাই অনেকে সি এ তে আসতে পারে না। কিন্তু কষ্ট করে আর্টিকেল পিরিয়ড পার করতে পারলে এই খরচ নিশ্চিতভাবে উঠিয়ে নেয়া যায়।
মেধাবী স্টুডেন্টদের জন্য সিএ ফার্মে সাধারন এলাউন্স এর থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি এলাউন্স ধার্য করা হয়।